চলতি বছরের শুরুর দিকে ১৫ বছর বয়সী মালয়েশিয়ার এক কিশোরী টুইটারে লিখেছিলেন, দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখেন তিনি।
কিন্তু হিজাব পরা ছিলেন না বলে অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনা ও বিদ্রূপের মুখে পড়তে হয় ওই কিশোরীকে।
মালয়েশিয়ার মুসলিম নারীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন, আর তা কতটা ব্যাপক তারই খোঁজ নিয়েছেন সুরেখা রাগাভান।
বিশ্বের সবখানেই অনলাইনে যে মেয়েরা হয়রানির শিকার হয় তা গোপন কিছু নয়।
মালয়েশিয়াতেও সব ধর্মের মেয়েরা হয়রানির শিকার হয়।
তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশটিতে মুসলিম নারীদের লক্ষ্য করে হয়রানি করা হচ্ছে এবং সামাজিক প্রত্যাশা থেকে এ হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশিরভাগ নারী।
“আমরা একটা ট্রেন্ড দেখতে পাচ্ছি যে মুসলিম নারীদের (মালয়-মুসলিম) ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে টার্গেট করা হচ্ছে। বিশেষ করে তারা কিভাবে নিজেদের প্রকাশ করছে, তাদের পোশাক-আশাক কী, সেই বিষয়টা লক্ষ্য করছে”- বলেন জুয়ানা জাফর, তিনি নারীদের অধিকার আদায়ে লড়াই করেন। ১৫ বছর বয়সী ওই কিশোরীর মামলাও তিনি লড়ছেন।
মিস জাফর বলছেন, ওই কিশোরীকে লক্ষ্য করে যেসব বক্তব্য এসেছে তা খুবই নির্মম। শেষ পর্যন্ত সে তার একাউন্ট মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছে এবং অফলাইনে থেকে সাহায্য চেয়েছে।
“আপনার যদি মালয়দের মতো নাম হয় তাহলে আপনাকে দৃশ্যমান দেখাবে”।
অনেক রক্ষণশীল সমাজে কে কী করলো না করলো, প্রতিবেশীর কাজ বা ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করার সংস্কৃতি রয়েছে।
আর অনলাইনে এখন এটি ব্যাপকভাবে হচ্ছে। মালয় ভাষার যেসব ট্যাবলয়েড আছে সেখানে এসব ‘পরচর্চার’ বিষয়টি বেশ চলছে।
মিস জাফর বলছেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যখন দেখা হয় তখন এটি আরো বেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইস্যু হয়ে দাড়ায়।
“ধর্ম কিন্তু এসব পরচর্চাকে উৎসাহ দেয় না। হাদিসেও আছে সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে কথা বলো, কারো গোপন বিষয়ের প্রতিও শ্রদ্ধা রাখো” বলছেন তিনি।
‘তারা অবশ্যই আমার শরীরে ত্রুটি খুঁজবে’
“বিশ্বব্যাপী এমনটা ঘটছে। তবে মালয়েশিয়ায় এটা যেন আলাদা একটা রূপে আসছে। ধর্মের বিষয়কে টেনে এনে খুবই নীচু মনমানসিকতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে এখানকার মানুষ” বলেন ড: আলিশিয়া ইজহারউদ্দিন, ইউনিভার্সটি অব মালয় এর জেন্ডার স্টাডিসের প্রভাষক তিনি।
‘সোশ্যাল মিডিয়া ঘৃণামূলক বক্তব্য ও সাইবার বুলিং নিয়ে মন্তব্য করার জন্য তা ভালো না মন্দ তা বিচার করার জন্য এখানকার মানুষ এখন নিজের পরিচয় গোপন রাখে”।
মালয়েশিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় দিনে দিনে তরুণীদের উপস্থিতি বেড়েছে, বিশেষ করে টুইটারে এবং সেই সাথে অনলাইনে হয়রানির ঘটনাও বেড়েছে।
নিয়মিত টুইটার ব্যবহার করেন মারিয়াম লি, তাঁর বয়স ২৫ বছর। সম্প্রতি তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-হিজাব পরা ছেড়ে দেবেন।
এই খবরটা টুইটারে শেয়ার করার পর তিনি এমন হয়রানির শিকার হয়েছেন, শারিরীকভাবেও তার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
“এটা শুধু এমন না যে মানুষ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করছে না।আপনার শরীরে ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে। আপনি যে মানুষ, আপনার যে ব্যক্তিত্ব -পুরোটার ওপরেই তারা শাসন করবে, ভয় দেখাবে” বলেন তিনি।
বহুদিন ধরেই অনলাইনে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তিনি। মিস লি জানালেন, হয়রানি তীব্র হলো যখন প্রকাশ্যে তাকে নারীবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।
“আপনি যখন সমাজের কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন, আপনার মতামত জানাবেন। তখন তারা আরো বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে” বলেন তিনি।
‘নারীর শরীর যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র’
অন্যদিকে যেসব নারী খুব মেকাপ করে এবং আঁটোশাঁটো পোশাক পরে তারাও যেন ‘মহা অপরাধ’ করে ফেলে, নারীদের ওপর সহিংসতার ঘটনার জন্য তাদেরও অনেকাংশে দায়ী করা হয়।
ডায়ানা সোফিয়া, ডিএপি সোশ্যালিস্ট ইয়োথ পার্টির একজন নির্বাহী সদস্য। কিন্তু তাকে নিয়ে স্থানীয় সাইটগুলোতে বিভিন্ন আলোচনা হয়, অনেক ‘গসিপ নিউজ’ও হয়েছে তাঁকে নিয়ে, তাঁর পোশাক নিয়ে।
মিস সোফিয়ার মতে, তাঁকে যেসব আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়, তাঁর পুরুষ সহকর্মীদের এরকম কোনো ঘটনার মুখে পড়তে হয় না।
“নারীর শরীরটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র, পুরুষের যুক্তিতর্কের একটা প্রধান বিষয়। একজন নারী হয়তো পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরোটাই ঢেকে রাখছে-কিন্তু দেখা যাবে কেউ হয়তো তারপরও তার পোশাক নিয়ে কথা বলবে। হয়তো বলবে-যেভাবে সে পোশাক পরেছে তা সঠিক হয়নি বা তার পোশাকটা আরো লম্বা হলে ভালো হতো” এক ইমেইলের মাধ্যমে একথা বলেন সোফিয়া।
অন্যদিকে টুইটার ব্যবহারকারী নালিসা আলিয়া আমিন সমকামীদের পক্ষে মন্তব্য করায় অনলাইনে ব্যাপক হয়রানির শিকার হন।
‘মালয়েশিয়ার আদর্শ মুসলিম নারী’র ইমেজ ভেঙে দিয়েছেন নালিয়া আমিন।
“যেসব মানুষ আমার দৃষ্টিভঙ্গি মানতে পারে না তারা আমি দেখতে কেমন, বিশেষ করে আমার শরীরটা কেমন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে” বলেন তিনি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় মিস আমিনের ছবি নিয়েও অনেকে ব্যঙ্গ করেন, এমনকি জীবজন্তুর পাশে তার ছবি বসিয়ে তুলনাও করেছেন অনেকে।
বেশিরভাগ নারীই বলেছেন যে মালয়েশিয়ায় মুসলিম পুরুষরাই মূলত অনলাইনে এরকম হয়রানি করে থাকেন।
হয়রানির শিকার বেশিরভাগ নারী শারিরীকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, কিন্তু অনলাইন এ সহিংসতা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরেও বিরাট আঘাত হানছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন নারীরা।
টু্ইটার ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী আরলিনা আরশাদ বলেছেন তাঁর শরীরের ওজনের কারণে ব্যাপক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাঁকে এবং এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তিনি আত্মহত্যা করার চিন্তা পর্যন্ত করেছিলেন।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো আরলিনার ‘সুইসাইডাল মেসেজ’টি পড়ে অনেকে খুব নির্মমভাবে মন্তব্য করেছেন, অনেকে বলেছেন মানুষের মনোযোগ আকষর্ণের জন্য তিনি এ কাজ করছেন।
এমনকি এই মন্তব্যও ছিল যে “তুমি যদি তাকে ছুরি মারো তাহলে তার শরীরের চর্বির কারণে ছুরি বেশিদূর যাবে না”।
মালয়েশিয়ায় বর্তমানে জেন্ডার-ভিত্তিক আইন নেই।
“আইন অপরিবর্তনশীল। রক্ষণশীল, কেন্দ্রীভূত একটা বিষয়। আপনি আজ আইন পাশ করতে পারেন আবার আগামীকাল সেটা পরিবর্তনও করে ফেলতে পারেন। এটা আসলে তেমনভাবে প্রয়োগ হয় না” বলেন সেরেন লিম। ইন্টারনেটে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে স্থানীয় এনজিও এমপাওয়ারের মাধ্যমে তিনি রিসার্চ এন্ড রিসোর্স ডেভেলপেন্টের কাজ করছেন।